অন্ধকারের আলো একজন মিহিত গুহ চৌধুরী বাবলা
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
সিলেটে মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর দ্বারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ভয় কিংবা সমঝোতাতে হয়তো ধামাচাপাই পড়ে যেতো।
কিন্তু এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতার সাহসী ভূমিকাতেই বিষয়টি আলোর মুখ দেখে, ভেস্তে যায় সমঝোতা বা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। শনাক্ত হয় অপরাধীরা এবং পর্যায়ক্রমে সব আসামিই গ্রেপ্তার হয়।
তিনি টিলাগড়ের গোপালটিলা এলাকার বাসিন্দা মিহিত গুহ চৌধুরী বাবলা। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদকের পরিচিতি বাবলা চৌধুরী হিসেবেই।
ধর্ষণের আগেই ওই নারী ও তার স্বামীর কাছ থেকে টাকা এবং সোনার গয়না ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। ধর্ষণের পর তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ছাত্রাবাস থেকে বের করে দেয় তারা।
এমনিকে তাদের ব্যক্তিগত গাড়িও আটকে রাখে এবং গাড়ি ফেরত নিতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে বলে জানিয়ে দেয়।
ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে পুলিশকে খবর দিয়ে একটা অটোরিকশায় স্ত্রীকে নিয়ে কলেজের পাশের এলাকায় এক দোকানের সামনে অপেক্ষায় থাকে তারা।
এ পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ তাদের ভিড় করে থাকলেও কেউ বাড়িয়ে দেয়নি সাহায্যের হাত। তখন ভীত এই দম্পতির সহায়তায় এগিয়ে আসেন বাবলা চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘রাত প্রায় ৯টার দিকে আমি আমার বাসা থেকে টিলাগড় পয়েন্টের দিকে যাচ্ছিলাম। দেখলাম একটা ছেলে কান্নাকাটি করছে। এলাকার মানুষ অনেকেই ছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে?” সে ঘটনা জানালে বললাম, “চলেন এখনই।”’
‘এরই মধ্যেই তার মোবাইলে কল আসে। কল দেয় ধর্ষকদের একজন। সে হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। আমি কল ধরে তাদেরকে বললাম, “তোমরা কোথায় আছো? থাকো আমি আসছি।” স্থানীয় কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে তাদেরই মোটরসাইকেলে করে দ্রুত রওনা দিলাম ছাত্রাবাসের দিকে। মেয়েটা আর তার স্বামীও অটোরিকশায় করে সঙ্গে আসে।’
‘এর মধ্যেই আমরা আন্দাজ করেছি কারা ঘটনা ঘটিয়েছে। এরা দীর্ঘদিন ধরেই কলেজ ও ছাত্রাবাস এলাকায় ছিনতাই-ইভ টিজিং করছে। একজনের মোবাইলে ফেসবুক থেকে তাদের কয়েকজনের ছবি দেখাতেই মেয়েটির স্বামী নিশ্চিত করে যে এরাই ছিল।’
‘সব মিলিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা মূল জায়গায় চলে গেলাম। বিষয়টা রিস্কের ছিল। ওদের কাছে অস্ত্রও ছিল। ভিকটিমের গাড়িটা আগে যেখানে ছিল, সেখান থেকে ততক্ষণে সরিয়ে ফেলেছে। আমরা অন্ধকারে খুঁজতে লাগলাম। তখন দেখলাম পাঁচ-ছয় জন করে ছেলে ঘোরাঘুরি করছে, দূর থেকে আমাদের ফলো করছে। তারপর জোরে চিৎকার দিলাম, “এইখানে কী কোনো মানুষের বাচ্চা নাই? কারা আছে এইখানে? বন্ধের সময় কারা হোস্টেলে থাকে?” এভাবে সামনে যেতে থাকলে দেখলাম কয়েকটা ছেলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। তাদের হাতে দা-টাও দেখা যাচ্ছিলো।’
‘তারপর আমি দেখলাম কর্নারের একটা ঘরে লাইট জ্বলছে। গিয়ে দেখি ঘরের সামনে অন্ধকারের মধ্যে ভিকটিমের হাজবেন্ডের গাড়িটি রাখা। ঘরের টেবিলের উপর দুটি মোবাইল, গাড়ির চাবি এবং ইয়াবা সেবনের বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। আমাদের দেখে পালাতে গিয়ে তারা তাদের একটি মোটরসাইকেলও রেখে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে শাহপরাণ থানার ওসিকেও কল দিচ্ছিলাম।’
‘সেখান থেকে গেটে ফিরলাম। দেখলাম ওসি সেখানে দাঁড়িয়ে। তাদের (অভিযুক্ত ধর্ষকদের) গডফাদাররাও চলে এসেছেন মেজরটিলা থেকে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ আর যুবলীগের দুই নেতা। তারা দেখলাম ওসির সঙ্গে কথা বলছে। ওসি ভিতরে যাচ্ছেন না। প্রায় একঘণ্টা গেটেই ছিলেন তিনি, ভিতরে যাননি। তবে একজন এসআই আমার সঙ্গে ভেতরে গেছেন। তাকে সব আলামত দেখলাম।’
‘গেটে থাকা স্থানীয় অনেকেই আমাকে বললেন যে ওই নেতারা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। আমি ওসিকে বললাম, “যা প্রমাণ পাওয়া গেছে, সব ডকুমেন্ট আছে আমার কাছে। আপনার অফিসারকে বুঝিয়ে দিয়েছি। যদি এখন কোনো রকমের উল্টাপাল্টা করেন, তাহলে উপরমহলে প্রমাণসহ দরখাস্ত করব। এত বড় পাপ আপোষে যাবে, এই সেক্রিফাইস করবো না।”’
‘তারপর সব পুলিশই ভিতরে ঢুকেছেন। ওসি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, “৮০ পার্সেন্ট কাজ আপনি করে ফেলেছেন, এবার আমরা আসামিদের ধরে ফেলব।” অথচ তিনি হোস্টেলের ভিতরেই যাচ্ছেন না। ওই নেতারাও ঘটনাস্থল থেকে গেছে রাত ১২টার দিকে।’
‘এদিকে যখন নানা কারণে সময় নষ্ট হচ্ছিল, মেয়েটার অবস্থাও তখন খুব খারাপ। আমি ওর জন্য পানি আনালাম, পুলিশকে বললাম তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, মেডিকেলে পাঠাতে। “দুই ঘণ্টা ঘরে কী করছেন ভিকটিমকে রেখে।” পরে রাত ১২টার কিছুক্ষণ আগে ভিকটিমকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।’
‘ঘটনা ৯টার আগের। ছেলেটাকে ৯টার সময় পেলাম। যদি তখন দ্রুত না আসতাম, ওরা (অভিযুক্ত ধর্ষকরা) আরও সময় পেতো, তাহলে সব আলামত গায়েব হয়ে যেতো। ওসিও এসেছেন তার আধাঘণ্টা পর। এর মধ্যে আমি তিনবার কল দিয়েছিলাম।’
‘আমার উপর ওরা গুলি করতে পারতো। কিন্তু সাহস করতে পারেনি, হয়তো প্রকৃতি আমাকে সাহায্য করেছে, আমি ভালো কাজে গিয়েছি বলে। তবে এই রিস্কটা নিয়েছি। নাহলে সব প্রমাণ নষ্ট করে ফেলতো ওরা। কেউ জানতোই না কী ঘটেছে। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা চলে যেতো। ওসির কাছে গেলেও বলতো, এমন কিছু ঘটেনি। অনেক কিছুই হতে পারতো। স্পটেও শেষ করতে চেয়েছে, কিন্তু আমরা থাকায় আর সেটা পারেনি।’
বাবলা চৌধুরীর ভাষ্যমতে শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ঘটনাস্থলে পৌঁছান তিনি আসারও প্রায় আধাঘণ্টা পর।
তারও বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত পুলিশকে কলেজ ছাত্রাবাসে প্রবেশের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়, যদিও অনুমতি পাওয়ার আগেই একজন উপপরিদর্শক বাবলা চৌধুরীর অনুরোধে ভিতরে প্রবেশ করেন। আর অনুমতি পাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ছাত্রাবাসে ঢোকেননি ওসি।
ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক জামাল উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি সে রাতে সিলেটে ছিলাম না, সুনামগঞ্জে গিয়েছিলাম। রাত ৯:২০ বা সাড়ে ৯টার দিকে ওসি অনুমতি নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলেন। তবে আমি না থাকায় পরে হোস্টেল সুপার আলী হায়দার, জীবনকৃষ্ণ এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক তৌফিক স্যার ঘটনাস্থলে আসেন।’
তবে জামাল উদ্দিন ৯:২০ বা সাড়ে ৯টায় ওসির কল পাওয়ার কথা বললেও আরেক তত্ত্বাবধায়ক জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বলেন একটু ভিন্ন সময়ের কথা।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি ছাত্রাবাসের শ্রীকান্ত ব্লকের কোয়ার্টারে ছিলাম। রাত ৯টা বা এরকম সময়ে অধ্যক্ষ কল করে জানান ছাত্রাবাসে পুলিশ এসেছেন, তাদের সঙ্গ দিতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাই এবং পুরোটা সময়ই ঘটনাস্থলে ছিলাম।’
তবে পুলিশ ছাড়া বহিরাগত কারা ছিলেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের অনেকেই সিভিল ড্রেসে ছিলেন। আর তাই কে পুলিশ আর কে পুলিশ না, তা বুঝতে পারিনি। তবে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অনেকেই এসেছিলেন সেখানে।’
সমঝোতা বা ধামাচাপার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা প্রশ্ন আসছে বারবার যে ভিকটিমকে কেন এতক্ষণ আটকে রাখা হলো, কেনো এত দেরি হলো। আমি শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলেই ছিলাম, আর এতটা সময় আসামি শনাক্তের চেষ্টা চলছিল, তাই দেরি হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সমঝোতা বা অন্য কোনো কিছু আমি লক্ষ্য করিনি।’
এদিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বিলম্ব, গড়িমসি, সমঝোতার অভিযোগ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
এ সময় তিনি দ্য ডেইলি স্টারের প্রশ্ন শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি বিনীতভাবে ক্ষমা চাচ্ছি। এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। সবকিছু মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা স্যার জানেন, আপনি উনাকে জিজ্ঞেস করেন।’
তবে এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার ব্যক্তিগত অভিযোগ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে জানতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) সোহেল রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ছাত্রাবাসে প্রবেশ করতে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। অনুমতি পেতে আর সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ঘটনাস্থলে আসতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু এরপরই পুলিশ ছাত্রাবাসে প্রবেশ করেছে।’
তবে সমঝোতার উদ্যোগ কিংবা উপস্থিত ছাত্রনেতাদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে প্রশ্নের আগেই তিনি লাইন কেটে দেন এবং পরবর্তীতে ফোন কল ধরেননি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সব অপরাধীরই গডফাদার থাকে। এদেরও আছে। আর এ গডফাদারদেরও গডফাদার রয়েছেন। যদি বাবলা চৌধুরীর মতো মানুষের কারণে ঘটনা ফাঁস না হতো, তাহলে এসব নেতাদের আর আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর মাধ্যমেই বিষয়টি হয়তো ধামাচাপা পড়ে যেতো।’
দ্যা ডেইলি স্টার