ভারতে ৩০ বছর জেল খেটে দেশে ফিরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
মো. মমতাজ মিয়ার বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। প্রায় ৩০ বছর আগে স্ত্রী, ৭ বছর বয়সী মেয়ে ও ৫ বছর বয়সী ছেলে আমির হোসেনকে রেখে কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়েছিলেন। এরপর আর তিনি দেশে ফেরেননি। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে ভারতের শিলচর কারাগারে সাজাও খাটেন। কিন্তু সাজার মেয়াদ শেষের পরও স্বজনদের সঙ্গে যোগযোগ করতে না পারায় দেশে ফিরতে পারছিলেন না তিনি।
অবশেষে সোমবার দুপুরে দেশে ফিরেছেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ভানগাদ্দা গ্রামের বাসিন্দা মো. মমতাজ। ৫ বছর বয়সে রেখে যাওয়া ছেলে আমির হোসেন এখন ৩৫ বছরের যুবক। বাবাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মমতাজের মতো আরও ৪১ জন সোমবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সিলেটের বিয়ানীবাজারের শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে সাজা ভোগ করেছেন। কিন্তু স্বজনদের খোঁজ না পাওয়ায় এত দিন ভারতে পাঁচটি ডিটেনশন ক্যাম্পে (ভারতে বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত কারাগার) আটক ছিলেন। দেশে ফেরা ৪২ জনের মধ্যে ৩টি পরিবারের ১২ জন সদস্য আছেন। তাঁদের মধ্যে একাধিক শিশুও কারাগারে থেকেছেন মা-বাবার সঙ্গে।
দেশে ফিরে মো. মমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন পরিবারের সদস্যদের চিন্তায় পাগলপ্রায় ছিলাম। দেশে পরিবারের সদস্যরা কীভাবে কী অবস্থায় আছেন, সে খবরও নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে হাইকমিশনের মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে আমার নাম-পরিচয় দেওয়ার পর দেশের পরিবারের খবর পাই। এরপর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য আমি অধীর আগ্রহে ছিলাম। আজ সেটি পূর্ণ হলো। পরিবারের সদস্যদের ফেলে ভারত তো দূরের কথা, আর কোথাও যাব না।’
ভারতের করিমগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত দত্ত এই ৪২ বাংলাদেশিকে বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিল্লোল রায় ও শেওলা স্থলবন্দরের অভিবাসন পুলিশের উপপরিদর্শক আবুল কালামের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় ভারত ও বাংলাদেশের সীমন্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ভারতে তাঁদের করোনা পরীক্ষা করা হয়। করোনা পরীক্ষার সনদ সঙ্গে নিয়েই ভারতের অভিবাসন পুলিশ শেওলা স্থলবন্দরের অভিবাসন পুলিশের হাতে তাঁদের হস্তান্তর করেন। এ সময় বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা নয়ন কুমার মল্লিক তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখেন।
বিয়ানীবাজার থানার ওসি হিল্লোল রায় বলেন, শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটকের পর সাজা ভোগ করা ৪২ বাংলাদেশিকে দেশে আনা হয়েছে। যথাযথ নিয়ম মেনে ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে শেওলা স্থলবন্দরের অভিবাসন পুলিশ ভারতের করিমগঞ্জ পুলিশের কাছ থেকে তাঁদের বুঝে নিয়েছেন। পরে তাঁদের দেশে অবস্থান করা স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
স্বজনেরা সন্ধান পেলেন যেভাবে
প্রায় আট বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মামা সাইদুর রহমানকে গ্রহণ করতে শেওলা স্থলবন্দরে এসেছিলেন মো. হাদী রুমেল আকন্দ। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম, মামা মারা গেছেন। এলাকার কয়েকজন ভারতে গিয়েছিলেন প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে। তাঁরা বলেছিলেন, মামার মতো দেখতে এক ব্যক্তি মারা গেছেন ভারতে। তিনি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। তবে নাম-ঠিকানা বলতে পারতেন।’ রুমেল আকন্দ জানান, গত ডিসেম্বরের দিকে অমলেন্দু কুমার দাশ নামের এক ব্যক্তি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে মামার ছবি দেখানোর পর তাঁরা চিনতে পারেন। এরপর থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং সাইদুরের বিভিন্ন কাগজপত্রও দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের বাসিন্দা অমলেন্দু কুমার দাশ। বছর কয়েক আগে তিনি ভারতে ঘুরতে গিয়েছিলেন। শিলচর, গোয়াহাটিসহ নানা এলাকায় ঘোরার পর জানতে পারেন সেখানকার বিভিন্ন জেলে অনেক বাংলাদেশি বন্দি আছেন। তাঁদের সাজার মেয়াদ শেষ হলেও দেশে ফিরতে পারছেন না। তিনি ভারতের গোয়াহাটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার শাহ মো. তানভীর মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর মাধ্যমেই তিনি ভারতের পাঁচটি ডিটেনশন ক্যাম্প কোকরা ঝাড়, গোয়াল পাড়া, তেজপুর, জোরহাট ও শিলচরে গিয়ে বাংলাদেশি বন্দীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। দেশে ফেরার পর বিভিন্ন মাধ্যমে স্বজনদের খুঁজে বের করেন। ভারতে নিযুক্ত সহকারী হাইকমিশনারের মাধ্যমে বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
ভারতে আরও প্রায় ৭০ জনের মতো বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন। তাঁদের স্বজনদেরও সন্ধান চলছে। এ ছাড়া আরও ছয়জনকে সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এ বিষয়ে অমলেন্দু কুমার দাশ বলেন, দেশে ৪২ জনের প্রত্যাবর্তনের কাজটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর আগেও বেশ কয়েকজনকে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সহযোগিতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এবারই প্রথম এত বেশি বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সমাজকর্মী হিসেবেই তিনি এমন কাজ করছেন। কোনো লাভ–ক্ষতির জন্য নয়। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দিয়ে আলাদা একটি তৃপ্তি পাওয়া যায়। ভারতে আরও প্রায় ৭০ জনের মতো বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের স্বজনদেরও সন্ধান চলছে। এ ছাড়া আরও ছয়জনকে সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
দেশে ফিরলেন যাঁরা
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির উত্তর পানুয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, আবু তাহের, জলন্তী গ্রামের মো. কামাল হোসেন, মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. মনির হোসেন, ইসলামপুর গ্রামের মো. রুবেল হোসেন, হালুদিয়া গ্রামের আকরাম হোসেন, বাগেরহাটের তাজিনুর বেগম, বাবু পালন, রাজু হাওলাদার, সিলেটের জকিগঞ্জের আফতাব উদ্দিন, শাহীন আহমেদ, কানাইঘাটের মো. মজির উদ্দিন, গোলাপগঞ্জের লায়েছ আহমেদ, ওসমানীনগরের নজির আহমেদ, মৌলভীবাজারের বড়লেখার দেলোয়ার হোসেন, রাজনগর চা–বাগানের রণবীর সিংহ; ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আজিজ মিয়া, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির মোশারফ মোল্লা, মাগুরার উজাগ্রামের মো. রুবেল শেখ, দিনাজপুর সদরের রহিম উদ্দিন, নেত্রকোনার কেন্দুয়ার মো. সাইদুর রহমান, নবাবগঞ্জের জলিল হোসেন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মো. মমতাজ মিয়া, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সুভাস চন্দ্র দাস, বগুড়ার আদমদিঘীর মো. শহিদুল ইসলাম, গাজীপুরের শ্রীপুরের নুরুজ্জামান, পিরোজপুরের মাঠবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর আলী, স্ত্রী আয়েশা বেগম, ছেলে মো. আরিফ, মেয়ে জান্নাতি আক্তার, পিরোজপুরের জিয়ানগরের জামাল ফারাজি, স্ত্রী শিমুল বেগম, মেয়ে সাবিনা আক্তার, ছেলে সাকিবুল ইসলাম, ভনারিয়ার হরিণপালা গ্রামের মো. মাসুম হাওলাদার, মিনারা বেগম, মো. মিজান, মাসুমা আক্তার, মাঠবাড়িয়ার দুলাল মিয়া হাওলাদার, ছেলে মো. হানিফ হাওলাদার, স্ত্রী হানুফা বেগম, মেয়ে মরিয়ম আক্তার।
দালালদের খপ্পরে ছয় তরুণ
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা মো. কামাল হোসেন, মো. আবু তাহের, মো. ময়নুল হোসেন, রুবেল হোসেন, আকরাম হোসেন, দেলোয়ার হোসেন। তাঁদের সবার বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। সোমবার দেশে ফেরা ৪২ জনের মধ্যে তাঁরাও ছিলেন।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রায় দুই বছর আগে দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালো সুযোগ-সুবিধার চাকরির প্রলোভনে পা দিয়েছিলেন। দালালেরা ২০ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতে যাওয়ার পরপরই সেখানকার পুলিশ আটক করে। পরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁদের আটক করে। সেখানে প্রায় ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর দেশে ফিরতে পেরেছেন।
শুধু এ ছয় তরুণ নন, দালালদের প্রলোভনে পা দিয়ে উন্নত পরিবেশে বসবাসের আশায় ৩টি পরিবারের ১২ সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছিলেন। তাঁরাও সেখানে পরিবার–পরিজন নিয়ে কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। অবশেষে সোমবার তাঁরাও দেশে ফিরেছেন।
ভারতে প্রায় দুই বছর কারাবাস ভোগ করার পর বগুড়ার আদমদিঘীর মো. শহিদুল ইসলামও দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ভারতের গোয়াহাটিতে এক স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চেন্নাইয়ে যাওয়ার পথে ভুলে পাসপোর্ট ফেলে যান। এরপর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁকে কারাগারে দেওয়া হয়। তিনি দেশে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। কারাগারে থাকার সময়ই পাসপোর্টের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার আর ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।’
সূত্রঃ প্রথম আলো