লিবিয়ায় গিয়ে মাফিয়াদের থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে আনলেন মা
বিয়ানীবাজারের ডাকঃ
এ কোনো সিনেমার গল্প নয়। যে মা কখনো বাসে চড়ে ঢাকায় যাননি, সেই মা উড়োজাহাজে চড়ে সোয়া সাত হাজার কিলোমিটার দূরে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলির একটি দ্বীপে গিয়ে মাফিয়াদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনলেন নিজ সন্তানকে। মা শাহিনুরের এমন সাহসী ভূমিকা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত কুমিল্লাজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গত ২১ মার্চ ছেলেকে নিয়ে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কালিকাপুর নিজ গ্রামে ফেরেন শাহিনুর বেগম।
সোমবার সরেজমিনে উপজেলার কালিকাপুর শাহিনুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে অনেক ভিড়। সবাই মা-ছেলেকে দেখতে ভিড় জমিয়েছে। শাহিনুর বেগম ও তার পুত্র ইয়াকুব হোসাইনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনি। শাহিনুর বেগম বলেন, ‘সবাই বলছিল আমার ছেলে মারা গেছে, তাকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চার দফায় ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আমি ও আমার লিবিয়াপ্রবাসী স্বামী দালালকে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ছয় মাসেও ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে লিবিয়াপ্রবাসী স্বামীর সহযোগিতায় পাসপোর্ট ও ভিসা নিশ্চিতকরে নিজেই লিবিয়ায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
পরিবারের দৈন্য ঘোচাতে প্রায় ১১ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০১১ সালে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান আবুল খায়ের। এর মধ্যে দুই কন্যার বিয়ে হয়ে যায়। অভাবের সংসারে আরো একটু সচ্ছলতা আনতে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ২০১৯ সালের মে মাসে একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকেও পাঠানো হয় লিবিয়ায়। ইয়াকুব হাসান লিবিয়ায় বেনগাজি শহরের কনস্ট্রাকশন ফার্মে কর্মরত তার বাবার কাছে থাকতেন। প্রথম দুই বছর ভালোই চলছিল তাদের সংসার। ইয়াকুব প্রথম এক বছর ‘আল হারুজ’ তেলের পাম্পে ৩৫ হাজার টাকায় এবং পরের এক বছর হাকজিলতন তেলের পাম্পে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।
পরে সিলেটের হবিগঞ্জের দালাল জাহাঙ্গীরের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে বোটে করে ১৫০ জন ইতালি যাওয়ার পথে লাম্পেদুসা দ্বীপে ‘মাফিয়াদের’ হাতে ধরা পড়েন ইয়াকুব। ওখান থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য এক বাঙালি দালাল ধরে বাবার সহযোগিতায় চার লাখ টাকায় মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় দফায় মাফিয়া চক্র লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের নিকট তাদের বিক্রি করে দেয়। কোস্ট গার্ড ওখান থেকে তাদের অন্য একটি দ্বীপে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে চলে অমানবিক জীবন। একেটি কক্ষে প্রায় ৬০-৭০ জনের অবস্থান। খাদ্যসংকট, শারীরিক নির্যাতনসহ নানা কারণে প্রতিদিনই মরছে সাথিরা। লাশের পচা গন্ধ, পেটের ক্ষুধা, পানিসংকট আর টাকার জন্য চলে বন্দুকের বাঁটের আঘাত ও পানির পাইপের পেটানি। শরীরের ক্ষতচিহ্নে পচন ধরেছে ইয়াকুবসহ অন্যদের। প্রতিদিন একটি রুটি, কোনো দিন আধা রুটি খেয়ে শরীরের যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এ সংবাদে তার বাবা আবুল খায়ের হার্ট অ্যাটাক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ইয়াকুব বলেন, ‘জেলে আমাদের খুব অত্যাচার করা হতো। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্ট গার্ডকে চার লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই। ‘ এরপর প্রায় আট মাস পর আবারও ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব। এবার তার বিপদ আরো বেড়ে যায়। এ সময় ‘মাফিয়ারা’ তাকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
ছেলের খবর পেয়ে শাহীনুর বেগম বলেন, লিবিয়ায় গিয়ে স্বামীর সঙ্গে ব্যাঙ্গাজি শহরে অবস্থান করি। পরে পর্যায়ক্রমে প্রথমে বাংলা ভাষা জানেন এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে সব খুলে বলি। তারা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। গত ২১ মার্চ ছেলেকে নিয়ে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে ফেরেন।
শাহিনুর বলেন, ‘আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। তারা ফোনে আমার সঙ্গে ওর কথা বলিয়ে দেন। ফোনে যখন ছেলের কণ্ঠ শুনি তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।”