আলুর কেজি ৩ টাকা
‘গ্যানোলা আলু তিন টাকা কেজি। মোটা চাল সর্বনিম্ন ৪২ টাকা কেজি। যদি আলু তিন টাকা কেজি হয়, তাহলে ১৪ কেজি আলু বিক্রি করে এক কেজি চাল কেনা যাবে। আর আমা’র বাড়িতে দৈনিক চাল লাগে প্রায় তিন কেজি। তাহলে হিসাব অনুযায়ী এক মণ আলু বিক্রি করে আমা’র বাড়িতে তিন বেলার ভাত হয়। এভাবে কি চলা যায়?’আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের সদর উপজে’লার মাঝাডাঙ্গা এলাকার কৃষক মমিনুল ইস’লাম। মমিনুল ইস’লাম পেশায় কৃষক, অবসরে এলাকায় মানুষের চিকিৎসা করেন। তবে শহর খুব কাছে হওয়ায় কৃষি পেশাই তার ভরসা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত জন। পরিবারের সদস্যদের জন্য তিনবেলা খাবারে লাগে প্রায় তিন কেজি চাল।মমিনুল ইস’লাম বলেন, আম’রা যখন আলু লাগাই তখন বীজ বেশি দামে কিনেছি।
এখন আলু তুলবো, আলুর দাম নাই। এই আলুগুলো যদি দেশের বিভিন্ন জে’লাগুলোতে পাঠানো যেতো, তাহলে দাম ভালো পেতাম। কিন্তু এখন আলুগুলো যাচ্ছে না। আলুতে এবার এত লোকসান, জমিতে যে সার-বিষ দিছি সেগুলোর খরচই উঠবে না।বর্তমানে গ্যানোলা আলু তিন টাকা কেজি যাচ্ছে। এই দাম দিয়ে তো কাজের লোকের টাকাই উঠে না। যদি আলু সাত টাকা দরে বিক্রি করি, তাহলে হয়তো আলুর বীজের দামটা উঠবে। কিন্তু বাকি সব খরচের টাকা উঠবে না। এজন্য আম’রা কৃষকরা এবার ধ’রা। সরকার যদি আমাদের কৃষকদের বিভিন্ন ভূর্তকি দিয়ে দেখতো তবে হয়তো ভালো হতো। এ বছর আলু আবাদ করেছি ২ বিঘার মতো। খরচ এখন পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকার মতো হয়েছে। মমিনুল ইস’লামের মতো অবস্থা দিনাজপুর জে’লার প্রায় সব কৃষকেরই। আলুর দাম নেই, ফলে কৃষকের এবারে মা’থায় হাত। জে’লায় আগাম জাত হিসেবে
কৃষকরা গ্যানোলা, ক্যারেজ ও স্টারিজ জাতের আলুর চাষ করেন। এবারে গ্যানোলা আলু কৃষকরা বিক্রি করছেন তিন থেকে পাঁচ টাকা কেজি, আর ক্যারেজ ও স্টারিজ আলু বিক্রি করছেন সাত টাকা কেজি দরে। ফলে সবারই এবারে লোকসান।বিরল উপজে’লার মাঝাডাঙা এলাকার কৃষক লক্ষ্মী কান্ত রায়, আমি এবার দুই বিঘা আলু লাগাইছি। আলু উঠাইছি ভাই কিন্তু দাম নাই। তিন টাকা-চার টাকা আলু বিক্রি করলে লাভ হবে। বিষ, সার, বীজ মিলে বিঘা হারে খরচ হইছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এখন আলুর দাম যদি ভালো থাকতো তবে হয়তো ভালো লাভ হতো। দুইটা টাকার মুখ দেখতে পেতাম।বিরল উপজে’লার মাঝাডাঙা এলাকার রাজ কুমা’র রায়, এ বছর দুই বিঘা আলু আবাদ করেছি। বর্তমানের আলু তিন চার টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এই আলু যদি সাত টাকাও বিক্রি হয় তবুও লাভ থাকবে না। এই আলু এখন ১২ হইতে ১৪ টাকা বিক্রি হইলে তবেই লাভ হতো। রফিকুল ইস’লাম নামে এক আলু চাষি বলেন, তিন বিঘা মাটিতে খরচ এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আলু বিক্রি হচ্ছে সাত-আট টাকা কেজি দরে। এভাবে লাভ হবে না। সরকার তো আমাদের দিকে দেখে না। সরকার যদি আলুর দামটা ঠিক রাখতো। ১৪ থেকে ১৫ টাকা যদি আলু কিনতো তবে লাভ হতো।
মালঝার এলাকার কৃষক আব্বাস আলী বলেন, বাজার খুবই খা’রাপ। ক্যারেজ আলু সাত টাকা কেজি, গ্যানোলা আলু ৪-৫ টাকা কেজি। আমি ক্যারেজ আলু লাগাইছি। সেই সময়ে বীজ আলু নিয়েছি ৩০-৩৫ টাকা কেজি। সার-বিষ, কামলা-কৃষাণ অনেক খরচ। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে ফলন হয়েছে ৬৭ বস্তা। প্রতি বস্তায় আলু থাকে ৬৫ থেকে ৭০ কেজি। সাত টাকা কেজি বিক্রি করে পোষাবে না।তার দেওয়া হিসাব মতে প্রতি বিঘায় আলু হয়েছে চার হাজার ৩৫৫ কেজি থেকে চার হ’জার ৬৯০ কেজি। সাত টাকা করে কেজি হিসেবে এর দাম পড়ে ৩০ হাজার থেকে ৩৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ নিজের জমিতে চাষাবাদ করে তার লোকসান গুনতে হবে ২ থেকে ৭ হাজার টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, এবারে জে’লায় ৪৮ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর প্রতি হেক্টরে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধ’রা হয় ২৩ দশমিক ৭৭ মে.টন। এ পর্যন্ত আলু রোপণ হয়েছে ৪৬ হ’জার ৯১০ হেক্টর জমিতে।দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভা’রপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ এএসএম আবু বকর সাইফুল ইস’লাম বলেন, এখনও অনেকেই আলু রোপণ করছেন, ফলে লক্ষ্যমাত্রার অ’তিরিক্ত জমিতে আলু চাষাবাদ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। লাভজনক ফসল হওয়ায় অনেকেই আগাম আলু চাষে ঝুঁকছেন। এবারে উৎপাদন ভালো হয়েছে। বাজারদর ঠিক থাকলে কৃষকরা হয়তো লাভবান হতেন। তবে কৃষকরা যদি দেশীয় পদ্ধতিতে বাড়িতেই তিন থেকে চার মাস আলু সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন, তাহলে লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।