একদিনে সবাইকে হারাব কল্পনাও করতে পারিনি: প্রধানমন্ত্রী
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্ক:
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শেখ কামাল বেঁচে থাকলে দেশ ও সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারত।
তিনি বলেন, তার (শেখ কামালের) বহুমুখী প্রতিভাগুলো বিকশিত হলে দেশের সব অঙ্গনে অবদান রাখতে পারত এবং ওই চিহ্ন সে রেখেও গেছে। তার নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা ছিল। আজকে যদি বেঁচে থাকত হয়তো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত।
বুধবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামালের ৭১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নিজের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ছোটবেলা থেকেই কামাল যে শুধু খেলার মধ্যে থাকতো তা নয়, সাংসারিক কাজেও আমার মাকে সব রকম সহযোগিতা করত। ওই ছোট্ট বয়স থেকেই সে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করত।
ভাই শেখ কামালের প্রতিভার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, কামাল আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট। কিন্তু তার জ্ঞান-বুদ্ধি সব কিছুতে একটা পরিণতি বোধ ছিল। তার মেধা বহুমুখী ছিল। একদিকে যেমন ক্রীড়া সংগঠক অন্যদিকে সাংস্কৃতিক জগতেও তার বহুমুখী প্রতিভা ছিল। স্পন্দন শিল্পগোষ্ঠী সে সৃষ্টি করেছে। ঢাকা থিয়েটার যখন হয় সেখানেও তার অবদান ছিল। সে নিজে অভিনয় করত, গান গাইত; সেতার বাজাত। খেলাধুলার মাঠে ছিল তার সবচেয়ে বড় অবদান। ধানমণ্ডি এলাকায় কোনোরকম খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল না। সেই উদ্যোগ নেয় এবং ওখানকার সবাইকে নিয়ে ‘আবাহনী’ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পরেও কিন্তু এই আবাহনীকে আরও শক্তিশালী করে। একটা মানুষের মাঝে এই যে বহুমুখী প্রতিভা এটা সত্যিই বিরল ছিল।
রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ কামালের অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তার ভূমিকাও অপরিসীম। রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ছিল সাহসী ভূমিকা। ৬ দফা ঘোষণার পর থেকে যে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর থেকে যেভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল- গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। প্রতিটি সংগ্রামে কামালের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সে (কামাল) মিছিল নিয়ে চলে আসতো বটতলায়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই সঙ্গে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছে। এমনকি ২৫ মার্চে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। মুক্তিযুদ্ধের একটা সময় সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে সব বাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে।
শেখ কামাল নিজের জন্য কিছু চাইতো না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই আমি আর রেহানা যখন জার্মানের উদ্দেশে রওনা হই- আমি কামালকে জিজ্ঞেস করি, কামাল তখন মাত্র বিয়ে করেছে, একেবারে নতুন বউ। জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমাদের জন্য কী নিয়ে আসব? আমার একটা ডায়েরি ছিল সেই ডায়েরিতে কামাল লেখে দিল ‘এডিডাস বুট’ নিয়ে আসবা আমার খেলোয়াড়দের জন্য। আমি বললাম লিখে দাও সে লিখে দিল। সেই লেখাটা রয়ে গেছে। আমি তখন বলেছিলাম- এতগুলো প্লেয়ারের জন্য কী করে বুট নিয়ে আসব। কামাল বলেছিল- তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে আসবে। সে নিজের জন্য কোনো দিন কিছু চাইত না।
শেখ হাসিনা বলেন, লেখাপড়া, খেলাধুলা বা নাট্যচর্চা সবকিছুতেই তার অনবদ্য অবদান ছিল। তার নাটক আমি নিজে দেখতে গেছি। বিভিন্ন সময় উপস্থিত বক্তৃতা, সবখানে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখত। আব্বা তো বেশিরভাগই জেলে থাকতেন এবং কামালের জন্মের পর তো বেশিরভাগই জেলখানায় ছিলেন। কামাল তো আব্বাকে আব্বা বলে ডাকারই সুযোগ পায়নি। একসঙ্গে যখন খেলতাম আমি আব্বা বলে যখন ডাকতাম ও আমাকে জিজ্ঞেস করত- ‘হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি’।
তিনি আরও বলেন, দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য বিশেষ করে বাঙালি জাতির জন্য আমার বাবা যেভাবে সারাজীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমরা ভাইবোনরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সবাই বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, আমাদের সেই সুযোগ হয়নি কিন্তু আমার মা সব সময় আমাদের লেখাপড়াসহ সবদিকে নজর দিতেন। ছোটবেলা থেকেই কামাল শুধু খেলাধুলা তা নয় সাংসারিক কাজেও মাকে সহযোগিতা করত। ছোট্ট বয়স থেকে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করত। আজ কামাল আমাদের মাঝে নেই কিন্তু আজকে তার সৃষ্ট আবহানী ক্লাব এখনও আছে। আজ যদি বেঁচে থাকতো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত। সত্যিকার অর্থে আমার জন্যও ভালো হতো।
শেখ হাসিনা বলেন, এভাবে একদিনে সবাইকে হারাব এটা কখনই চিন্তা বা কল্পনাও করতে পারেনি। কামাল মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার ছিল। শেখ জামালও মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনাবাহিনীর একজন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। আমার চাচা শেখ আবু নাসের মুক্তিযোদ্ধা, শেখ ফজলুল হক মনি মুক্তিযোদ্ধা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন। কামাল যাদের সঙ্গে কাজ করেছে, যাদের সঙ্গে ছিল। এমনকি কর্নেল ওসমানী সাহেবের এডিসি আর একজন আর্মি অফিসার সেও একসঙ্গে কাজ করেছে। আর তাদের হাতেই নিহত হতে হল কামালসহ আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে। কী নির্মামভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আব্বা তো শুধু দেশ স্বাধীনই করেননি। তিনি তো এই সেনাবাহিনীও গড়ে তুলেছেন। যারা আমাদের বাড়িতে রীতিমতো আসা-যাওয়া করত। আমাদের বাড়িতে নাস্তা ভাত খায়নি এরকম কেউ নাই। আর তারাই যখন সরাসরি কামালের সামনে এসে কামালকে গুলি করে বা জামালকে গুলি করে বা বাড়িতে গুলি করল- একবার চিন্তা করে দেখেন! একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করে আমার কাছে, আমি কিন্তু বিচার পাইনি! আমরা বিদেশে ছিলাম আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দেয়া হয়েছে। দেশে যখন ফিরলাম, আমি মামলাও করতে পারিনি। কারণ মামলা করার অধিকার ছিল না। আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল যে মামলা করতে পারব না। ২১ বছর পর সরকারে এসে তারপর মামলা করে বিচার করি। কাজেই যখন বিচার চান তখন এটাই মনে হয় আমাদের তো কত বছর লেগেছে এই বিচার করতে।
শেখ হাসিনা বলেন, একজন রাষ্ট্রপতি যিনি দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন তার জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন দেশের জন্য যার সারাটা জীবন কারাগারে কেটেছে। সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তার পাশে থেকে শক্তি সাহস জুগিয়েছিলেন আমার মা, যার কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। তিনি নিজের জীবনের জন্য কিছুই চাননি। তিনিও সব সময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের সামরিক কর্মকর্তারা মেজরের উপরে উঠতে পারেনি। এখন জেনারেল হচ্ছেন লেফটেনেন্ট জেনারেল হচ্ছেন- এটা কেন হতে পারল, হতে পারল দেশ স্বাধীন করার জন্য। আব্বা নিজের হাতেই পদোন্নতি দিয়ে গেছেন। মেজর জিয়াকে মেজর থেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতিটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন। সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যার হাতে গড়া তাকেই হত্যা করে দিয়ে ঠিক যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সেই চেতনাটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কত নির্মমভাবে হত্যা! রাসেল একটা ছোট ১০ বছরের শিশু তার কী অপরাধ? আরিফ সেও সমবয়সী। সুকান্তর বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর! তাকেও হত্যা করা হয়েছে। একটা স্বাধীন দেশ, সেই স্বাধীন দেশেই হত্যাকাণ্ড হয়েছিল।
দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার করার, হত্যা বিচার করার সুযোগ পেয়েছি। দিনের পর দিন আমাদের কাঁদতে হয়েছে। আজকে কামাল নেই। আমাদের একসঙ্গে উঠাবসা, খেলাধুলা। একসঙ্গে চলাফেরা, ঝগড়াঝাটি। একসঙ্গে সাইকেল চালানো, একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা। যেহেতু আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি। আমরা পুতুল খেলার জন্য আমার সঙ্গে থাকত ওর সঙ্গেও বাকি সব খেলা খেলতাম। আমি যখন বিদেশে গেলাম। ১৯৬৯ সালে আব্বা মুক্তি পাওয়ার পর কামালের কথাই আমার সব থেকে বেশি মনে হতো। আমরা এত বেশি মাকে ঘিরে আব্বাকে ঘিরে ঘনিষ্ট ছিলাম যে, ওদের ছেড়ে যে কোনো দিন থাকতে হবে ভাবতেই পারিনি। কামালের এত বহুমুখী প্রতিভা। কামাল প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে সে তো কিছুই করেনি।
আবাহনী ক্লাব এবং স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আজকে তার সৃষ্ট আবাহনী ক্লাব এখনও আছে। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর অনেকেই মারা গেছেন, নতুনভাবে আবার স্পন্দন গড়ে তোলা হয়েছে। ফিরোজ শাহীর ছেলেসহ যারা উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সংসদ সদস্য সালমান ফজলুর রহমান এমপি এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
অনুষ্ঠানে শেখ কামালের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন শেখ কামালের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু ও সহযোদ্ধারা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন যুব ও ক্রীড়া সচিব মো. আখতার হোসেন।
অনুষ্ঠানে শেখ কামালকে নিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত ‘শেখ কামাল: এক কিংবদন্তির কথা’ শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল শেষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ শেখ কামাল- আলোমুখী এক প্রাণ’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অসহায় ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের আর্থিক অনুদান প্রদান করেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী।