দুশ্চিন্তায় মধ্যবিত্ত আর্থিক ও সামাজিক চাপে ভেঙে পড়ছে জীবনব্যবস্থা
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্ক:
যত সমস্যার মধ্যেই থাকুন না কেন, ‘কেমন আছেন’ প্রশ্ন করলে মধ্যবিত্তের প্রিয় উত্তর ‘ভালো আছি’। এই করোনাকালেও সবাই মুখে হাসি টেনে রাখলেও সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় পার করছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। চাকরি, ব্যবসা থাকে কি থাকে না—এই অনিশ্চয়তার মধ্যে পুরো জীবনটাই যেন আতঙ্কের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের।
এই সময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সবচেয়ে বড়ো সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ঘরে খাবার থাকে না, অথচ চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে চাইতে পারে না। একদিকে বাড়িভাড়া পরিশোধের চাপ, সন্তানদের স্কুলের বেতনের চাপ, অন্যদিকে প্রতি মাসে ব্যাংকের ‘ইএমআই’-এর চাপ তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের। এতসব দুশ্চিন্তার মধ্যে ভালো নেই মধ্যবিত্ত। সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর খবর এবং গার্মেন্টস খাতে ছাঁটাই মানুষকে আরো বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। হতদরিদ্ররা কারো কাছে চাইতে পারলেও মধ্যবিত্তের সেই উপায় নেই।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই অবস্থা চললে দুই মাসের মধ্যে অনেক মধ্যবিত্ত যোগ হবে নিম্নবিত্তের তালিকায়। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীতে বসবাসকারী অনেকেই ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। সংকটকালে নিম্নবিত্তের সমস্যা হয় না। তারা যে কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। উচ্চবিত্ত তাদের সম্পদের কারণে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। যত সমস্যা মধ্যবিত্তের। কারণ তাদের গতি থাকে উচ্চবিত্তের দিকে, কিন্তু দুর্যোগে সেই গতি থেমে যায়। তাদের নেমে যেতে হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পর্যায় হয়ে নিম্নবিত্তের পর্যায়ে। দীর্ঘ সময়ে গড়ে তোলা আর্থিক কাঠামো, মূল্যবোধকে ভেঙে দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সামাজিক ও আর্থিক চাপে ভেঙে পড়ে তাদের জীবনব্যবস্থা।
দেশ এক কঠিন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবী এক অজানা শঙ্কায় ভর করে চলেছে। এই মহামারি কবে নাগাদ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, সেটিও একরকম অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে চরমভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের জীবনমান, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। ঢাকার মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিংয়ে থাকেন মলয় কুমার দেবনাথ। বেসরকারি একটি ইংলিশ মাধ্যম স্কুলে চাকরি করেন তিনি। মলয় জানালেন, অনলাইনে ক্লাস চলছে। এরই মধ্যে স্কুলের বেতন অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। বাসাভাড়া দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
একটি রিয়েল এস্টেট ফার্মে কাজ করেন রায়হানুল আলম। তিনি বললেন, ‘গত তিন মাস ধরে ফ্ল্যাট বিক্রি নেই। বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ছাঁটাইয়ের মুখোমুখি হতে পারি। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।’ মোহাম্মদপুরে ‘হার্ডওয়্যারের’ দোকান রয়েছে লিয়াকত হোসেনের। তিনি বললেন, ‘দোকানে খুচরা বিক্রি হচ্ছে। যেহেতু বাড়ি নির্মাণ বন্ধ; দোকান ও গুদামের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা ভেবে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’
দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি অফিসের চাকরিজীবী, ব্যাংক-বিমার কর্মকর্তা, মাঝারি মানের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা—সবাই এখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যিনি পোশাকের ব্যবসা করেন তার দোকান বন্ধ। যিনি বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন, অনেকে বাসা থেকে অফিস করলেও সিংহভাগেরই কাজ প্রায় বন্ধ। যারা বিদেশ থেকে পণ্য এনে দেশে বিপণন করেন, তাদের ব্যবসাও বন্ধ। মাসের আয় একেবারেই বন্ধ। সঞ্চয় ভেঙে খেতে খেতে তা-ও এখন তলানিতে। তাই করোনার থাবায় দেশে সবচেয়ে বেশি বিপাকে মধ্যবিত্তরা।
মধ্যবিত্তের কিছু সঞ্চয় থাকে। লকডাউনে তারা সেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকের সঞ্চয় শেষ। কেউ হয়তো আর দুই-এক মাস চলতে পারবে। এরপর কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বললেন, ‘করোনা পরিস্থিতির যে সময়টা আমরা পার হচ্ছি, তা কবে কাটবে আমরা বলতে পারছি না। এই সংক্রমণের পর্যায় আমরা যদি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারি, তাহলে অর্থনৈতিক সব সমস্যাই আরো ঘনীভূত হবে। সরকার দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে সহায়তা দিচ্ছে। আমাদের সম্পদ এতটা নেই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও সহায়তা দেবে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে একজন চাকরিজীবীর শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। এ সময় যেন কাউকে চাকরিচ্যুত করা না হয়, সেই দিকে নজর দিতে হবে। এর পাশাপাশি যারা মধ্য পর্যায়ের ব্যবসায়ী, তাদের ঋণসহায়তা দেওয়া যেতে পারে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ক্ষতি মেনে নিয়ে নিজেদের সঞ্চয় দিয়ে সংসার চালাতে হবে। তবে এসব পরামর্শই সাময়িক। যদি আমরা দ্রুত করোনা সংক্রমণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে না পারি, তখন সব হিসাবই পালটে যাবে।’