সিলেটে ছেলের পাঁচটি বিশাল বাড়ী থাকা সত্ত্বেও মা রাস্তায় ভিক্ষা করেন!
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
বৃদ্ধা শুকুরা এটুকু বলতে পারছেন, ‘ছেলের বউ বের করে দিয়েছে। বলেছে, যেদিকে ইচ্ছা যাও। তাই আমি মুনাফিকদের ঘরে আর যাবো না। তারা এক ঘরে বন্দী করে রাখে। তাদের কাছে গেলেই ধমক দেয়।’
‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি।’ নচিকেতা তাঁর এই গানে সম্ভবত জীবন্ত কোন এক বাবা কিংবা মায়ের আকুতি বর্ণনা করেছিলেন। আর এমনই এক ঘটনা ঘটলো সিলেটে।
পাঁচটি বিশাল বাড়ি আর কোটি কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী ছেলের ঘরে একমাত্র কম দামি ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মা। যাকে টানা এক বছর এক কক্ষে বন্দী করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও দায়িত্ব নিতে হয়েছে পুলিশের।
বৃদ্ধা শুকুরা বেগমের মেয়ের ঘরের নাতনী সানজিদা সুলতানা বলেন, আমার নানীকে নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার ৭৮ নম্বর বাসায় তাঁর ছেলে সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী বন্দী করে রাখেন। এক বছর বন্দী থাকতে থাকতে সুযোগ পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় পাশের ঘরে যাওয়ার অপরাধে রাত ১০ টার দিকে তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলেন ছেলের স্ত্রী। সোমবার রাতে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে তিনি জীবনের শেষ বয়সে আশ্রয় নেয়ার জন্য নগরীর পথে পথে হেঁটে ভিক্ষা করে টাকা সংগ্রহ করে রাত কাটিয়ে পরদিন মঙ্গলবার সকালে কানাইঘাট এলাকায় নিজের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথেই সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পান এবং বাম পা ভেঙ্গে যায়। সেখান থেকে খবর পেয়ে নানীর ভাইয়ের ছেলে তাজুল ইসলাম তাকে স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার করে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে ভর্তি করেন। এর পর থেকে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন। কিন্তু ঘটনার খবর পেয়েও আমার মামা কিংবা তার পরিবারের কেউ নানীর কাছে আসেননি। তাই আমি কানাইঘাট থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি।
শুকুরা বেগম কানাইঘাট এলাকার চাপনগর এলাকার মৃত জোয়াহীদ আলীর স্ত্রী। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩ টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ৩ তলা ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শুকুরা বেগমের তত্ত্বাবধান করছেন সিলেট জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ওসমানী হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা সদস্য মো. জনি। পরের ছেলে হলেও দেখভাল করছেন নিজের মায়ের মতই।
গুরুতর আহত শুকুরা বেগম ঠিকমত কথা বলতে পারছেন না। জনি জানান, গতকাল দুপুরের পর শুকুরা বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল থেকে কানাইঘাট থানার ওসির নির্দেশে তিনি বৃদ্ধা নারীর সব রকম তত্ত্বাবধান করছেন।
তবে বৃদ্ধা শুকুরা এটুকু বলতে পারছেন, ‘ছেলের বউ বের করে দিয়েছে। বলেছে, যেদিকে ইচ্ছা যাও। তাই আমি মুনাফিকদের ঘরে আর যাবো না। তারা এক ঘরে বন্দী করে রাখে। তাদের কাছে গেলেই ধমক দেয়।’
ছেলে কি করেন জানতে চাইলে বলেন, আগে বিদেশ আতরের ব্যবসা করত। এখন দেশে ৪ টা বিল্ডিং আছে (বাসা)। অনেক টাকা মাসে ভাড়া পায়।
এদিকে শুকুরা বেগমের মেয়ের ঘরের নাতনী সানজিদা সুলতানা বলেন, আমার নানা মারা যাওয়ার পর নানী বাড়িতে থাকতেন। নানার অনেক সম্পদ। আর তাঁদের সন্তান বলতে আমার মা আর মামা সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী। এর মাঝে আমার মা মারা গেছেন। বেঁচে আছেন মামা। মামার সিলেট শহরে ২ টি বাসা, কানাইঘাটে গ্রামের বাড়িসহ তিনটি বাড়ি আছে। সব মিলে মোট ৫ টি বাসা তার। কিন্তু মামা নানীর কোন দায় নিচ্ছেন না। তারা গত এক বছর থেকে নানীকে গ্রাম থেকে এনে এক ঘরে বন্দী করে রাখেন। গ্রামের ঘরটি তালা দিয়ে রেখেছেন।
অপরদিকে অভিযুক্ত ছেলে সিরাজ উদ্দিনের ব্যবহৃত নম্বরে কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার স্ত্রী রেনু বেগমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যার মা দায় তাঁর। এখানে কেউ মামলা করে আর কিছুই করে কোন লাভ হবে না। আমরাতো দেখতে গিয়েছি। টাকাও দিয়েছি। সকল দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি। এখানে অন্য কারো মাথা ব্যথা কেন?
এদিকে কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, গতকাল (বুধবার) ওই বৃদ্ধার মেয়ের ঘরের একজন নাতনী অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন। তাৎক্ষনিক আমি বৃদ্ধার ছেলের সাথে কথা বলেছি। ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক। পরে আমি হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা জেলা পুলিশের সদস্য জনিকে বলেছি, যেন সে দেখাশোনা করে। অবশ্য আমার ফোন পাওয়ার পর ছেলে একবার গিয়ে দেখে এসেছে শুনেছি। তবে ওই বৃদ্ধার ছেলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান ওসি।