সিলেট বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনেই রায়হানের মৃত্যু : তদন্ত কমিটি
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানাধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড অবস্থানকালেই পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু হয় রায়হান উদ্দিন আহমদের (৩৩)। এসএমপি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রথম দিনের তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান উপকমিশনার (ডিসি) আজবাহার আলী শেখ।
আজবাহার আলী শেখ বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষায় দেখা যায়, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা ৯ মিনিট ২০ সেকেন্ডে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে থামে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে। পরে ওই অটোরিকশা থেকে তিনজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে হাতকড়া পরা অবস্থায় নামেন রায়হান। এরপর স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে হেঁটে ফাঁড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পরদিন রোববার ভোর ৬টা ২০ মিনিটে দুই পুলিশ সদস্যের ঘাড়ে ভর দিয়ে রায়হানকে মুমূর্ষু অবস্থায় অপর একটি অটোরিকশায় তোলা হয়। এরপরই সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মরদেহের সন্ধান পায় পরিবার।
রায়হান নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। রায়হানের বাবা একসময় সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে এবং তাঁর দাদা পুলিশে চাকরি করতেন। রায়হান নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে দুজন চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। রাহনুমা আক্তার নামের দুই মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তান রেখে গেছেন তিনি।
স্বজনদের অভিযোগ, ১০ হাজার টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশ দাবি করেছে, নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন রায়হান। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর বলছেন, যে এলাকায় গণপিটুনির কথা বলা হচ্ছে সেখানকার সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে এ ধরনের কোনোকিছু দেখা যায়নি।
শনিবার দিবাগত রাত ২টা ৩৮ মিনিটে নগরীর কাষ্টঘর এলাকা থেকে রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা আটক করেন বলে জানান উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ। তিনি জানান, ওই এলাকারও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ মিলেছে। সেখানে রায়হানকে গণপিটুনি দেওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সিসিটিভির ফুটেজ, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে জখম হয়েছেন রায়হান। পরে তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া বা অন্য কোনো পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান আজবাহার জানান, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বাতেন হাসান তদন্তের স্বার্থে যা উপযোগী মনে করবেন, তা করবেন।
এর আগে পুলিশি নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠায় গত রোববার এসএমপির পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) শাহরীয়ার আল মামুন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এহসান উদ্দিন চৌধুরী ও বিমানবন্দর থানার সহকারী কমিশনার প্রবাস কুমার সিংহ।
এদিকে, তদন্তে পুলিশ কর্মকর্তারা রায়হানের মৃত্যুর জন্য বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিকেলে ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় আরো তিন সদস্যকে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া তিন পুলিশ সদস্য হলেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
এদিকে, রায়হানের মৃত্যুর ঘটনার প্রধান সন্দহভাজন অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গতকাল জিন্দাবাজার ওয়েস্টওয়ার্ল্ড মার্কেটে একটি ইউটিউব চ্যানেল গ্রিন বাংলার অফিসে রাত ৯ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দেখা যায়। তবে তিনি রায়হানের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এ ঘটনায় রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত রাখা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রাণীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পায়।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’