করোনা: যাদেরকে হারালো সিলেটবাসী
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্ক:
সিলেটে বেড়েই চলছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। থেমে নেই করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও। করোনায় মৃত্যুর মিছিলে আছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, গরিবের চিকিৎসক খ্যাত ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন, শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারের নার্স (পুরুষ) রুহুল আমিনসহ সাংবাদিসক, আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ীসহ মোট ৫৭ জন। আলোচিত মৃত্যুগুলো যেমন সিলেটের মানুষকে কাঁদিয়েছে তেমনি সকল মৃত্যতেই নিহতদের পরিবারের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি।
এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরে কোথাও চিকিৎসা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে সিলেটের কোটিপতি ব্যবসায়ীসহ অন্তত চার জনের। সর্বশেষ শনিবার (২০ জুন) প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন সিলেটের প্রবীণ আইনজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ চৌধুরী আব্দুল্লাহ।
এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫৭ জন। এর মধ্যে ৪৫ জনই সিলেট জেলার বাসিন্দা। বাকি তিন জেলা হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে মারা গেছেন চারজন করে মোট ১২ জন। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে সিলেটে মারা গেছেন আরও ৭২ জন।
গত ১৫ এপ্রিল দেশে প্রথম চিকিৎসক হিসেবে মৃত্যু হয় সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের। এই মানবিক চিকিৎসকের মৃত্যু মানুষকে কাঁদিয়েছে যেমন তেমনি সিলেটে করোনা চিকিৎসায় যে হতশ্রি অবস্থা তা সবার সামনে পরিষ্কার হয়েছে। চিকিৎসক মঈনের আকুতি ছিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় পাঠানোর। কিন্তু তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়াতো দূরে থাক একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সও পাননি।
সিলেটে কেন ওই প্রথম রোগীর চিকিৎসা দেয়া গেলো না এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জোর সুরেই। একইসঙ্গে সিলেটের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে তখন।
ওই চিকিৎসক গত ৫ এপ্রিল সিলেটের প্রথম করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর দুই মাস ছয়দিন অতিবাহিত হতে চললেও এখনো তাকে হারিয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি ডা. মঈনের পরিবার। তার অবুঝ সন্তানরা এখনও বাবাকে খুঁজে ফেরে খাবার টেবিলে কিংবা ঘুমানোর সময়।
প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে জনতার মেয়র খ্যাত সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের প্রাণ। জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৫ জুন সোমবার ভোর পৌনে ৩টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুও সিলেটের আপামর জনসাধারণকে কাঁদিয়েছে। ওই দিন বাদ জোহর তাকে মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। করোনার ভয়কে দূরে ঠেলে সেদিন কামরানের জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ।
তবে এসব মৃত্যুর মধ্যে সিলেটজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় বিনা চিকিৎসায় কোটিপতি ব্যবসায়ীসহ তিনজনের রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু নিয়ে। কোটিপতি ব্যবসায়ীসহ দুই নারীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নিয়ে সিলেটের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সংগঠন, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সর্বমহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ফেসবুকে এনিয়ে তীব্র আলোচনা সমালোচনা হয়। সপ্তাহ ধরে চলে তোলপাড়।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, আওয়ামী লীগ, প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন বৈঠকে বসেন। এরপর সিলেটে বিনাচিকিৎসায় ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি ড. একে আবদুল মোমেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমানের সঙ্গেও কথা বলেন। একইসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসককে ই-মেইল করেন মন্ত্রী।
ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবেন, এটা চরম অমানবিক ও খুবই দুঃখজনক। এগুলো মেনে নেয়ার মতো নয়। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়া তার নাগরিক অধিকার। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য।
মন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থানের কারণে পরে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যে সিলেটের দুটি বেসরকারি হাসপাতাল নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ও মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাসেবা শুরু করে।
বর্তমানে সিলেটে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। শনিবার একদিনেই সিলেটে ১৭৭ জন পজিটিভ হওয়ার পর শনাক্তের সংখ্যা ৩ হাজার ১৬৩ জন ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও রেড জোনে পড়া সিলেটে লকডাউন নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সিলেটে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত মাল্টিসেক্টরাল কমিটি।
সিলেট বিভাগে করোনাভাইরাসে এপর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় রোগী বেড়েছে ১৭৭ জন। এর মধ্যে সিলেটে ১৭৬৮ জন, সুনামগঞ্জে ৭৮৮ জন, হবিগঞ্জে ৩৪২ জন ও মৌলভীবাজারে ২৬৫ জন। আর এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৬৯৩ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২০০ জন।