কুলাউড়ায় একটি পাঁকা সেতুর জন্য ৫০ বছর ধরে অপেক্ষায় চার গ্রামের মানুষ
কুলাউড়া প্রতিনিধিঃ
কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের চার গ্রামের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার আগ থেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও একটি পাঁকা সেতুর অভাবে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না আবুতালিপুর, রামপাশা, মিঠুপুর ও বেগমানপুর প্রায় ১০ সহস্রাধিক লোকজন। সেতু নির্মাণ না হওয়ায় নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধির উপর স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে নানা ক্ষোভ ও হতাশা। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের আক্ষেপ আদৌ কি এই সেতু হবে। নাকি সেতু নির্মাণের স্বপ্ন নিয়েই মরতে হবে এই ধারনা কাজ করছে তাদের মনে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশের একটি সাঁকো তৈরি করে দেয়ায় কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ অনেকেই সাময়িক যাতায়াত করতে পারছেন।
জানা যায়, উপজেলা জয়চন্ডী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গোগালীছড়া নদী। সেই উপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয় চারটি গ্রামের লোকজন। স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করলে প্রায় ৫০ বছর থেকে এই সাঁকোর উপর দিয়ে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার পথচারী ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পারপার হতে হয়। বাঁশের ওই সাঁকোটি প্রতি বছর খরা ও পানির স্রোতে ভেঙ্গে পড়লে এলাকাবাসী আবার তা পুনরায় সংস্কার করে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে তুলেন।
চার গ্রামের লোকজন স্বাধীনতার পর থেকে গোগালী ছড়া নদীর উপর একটি পাঁকা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের অনেক বড়কর্তাও। কিন্তু কবে বাস্তবায়ন হবে সেই প্রতিশ্রুতির আশায় এখনো পথ চেয়ে আছেন ভুক্তভোগীরা।
আবুতালিপুর, রামপাশা, মিঠুপুর ও বেগমানপুর গ্রামের মানুষ নিয়মিত এই সাঁকো দিয়ে চলাচল করে। এছাড়াও এলাকার শিক্ষার্থীরা সাঁকো পার হয়ে স্থানীয় দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রহমত আলী ও বন্দে আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে স্থানীয় ব্যক্তিরা চাঁদা তুলে সাঁকো সংস্কার করে থাকেন।
গোগালিছড়া নদীতে কয়েকটি পাকা ও বাঁশের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ খুঁটি এক পাশে কাত হয়ে গেছে। এর ওপর বাঁশ ফেলে নির্মিত হয়েছে সাঁকো। টানা কয়েক দিন বৃষ্টি দিলে নদীতে পানি বেড়ে যায়। প্রায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে কোমলমতি শিশুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁশ ধরে ধরে পার হতে হয় নদী। বর্ষা মৌসুমে সেখানে পানি অনেক বেশি থাকে। তখন সাঁকো পার হতে সবার ভয় লাগে। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এই সাঁকো দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। এখানে একটি পাঁকা সেতুর জন্য স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ উধ্বর্তন কতৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানালেও এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান মাছুম, ক্রিকেটার শাওন আহমেদ, সমাজ সেবক আজিজ মিয়া, আব্দুল আহাদ, আতাউর রহমান দুদু, মুরব্বী নওশা মিয়া, আব্দুন নুর, উস্তার মিয়া জানান, আবুতালিপুর, রামপাশা, মিঠুপুর ও বেগমানপুর গ্রামের ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে গোগালিছড়া নদীর উপর নির্মিত ওই সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে হয়। এলাকার মানুষ নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তাদের সে দাবি পূরণ হয়নি। এ অবস্থায় তারা দুর্ভোগের শিকার হয়ে বাঁশের সাঁকো দিয়েই নদী পারা পার হচ্ছেন। এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা সাঁকো পার হয়ে স্থানীয় দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রহমত মিয়া ও বন্দে আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করে। নদীর উপর সেতু নির্মাণের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে এবং স্বেচ্ছাশ্রমে সাঁকোটি মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করেন।
এভাবেই প্রতিবছর সাঁকো মেরামতের জন্য মানুষকে নিতে হয় উদ্যোগ। কিন্তু নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে সাঁকোটি তছনছ হয়ে যায়। বিপাকে পড়েন চলাচলকারী লোকজন।
দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেলী বেগম, ছালেহ আহমদ, রহিমা আক্তার, লিমা বেগম, রহমত মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়েম, আব্দুল্লাহ, তুলি, নাজমিন বলেন, একেতো ভাঙ্গা সাঁকো, তার উপর বর্ষাকাল একটু বৃষ্টি হলেই নদীতে পানি বেড়ে যায়। এবস্থায় সাঁকো পার হতে আমাদের খুব ভয় লাগে। আর এই সাঁকো পারাপারের ভয়ে প্রায় দিন অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে যায় না।
মিঠুপুর জামে মসজিদের ইমাম হাফিজ আমির আলী বলেন, আমি এ মসজিদে প্রায় ২০ বছর থেকে ইমামতি করছি। প্রতিবার বর্ষার সময় আসলেই সাঁকোটি ভেঙ্গে যায়। এসময় বয়স্ক মুসল্লিরা নামাজ পড়তে এবং সকালে মক্তবের শিক্ষার্থীরা আসতে পারেনা।
দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুপিয়া বেগম বলেন, এখানে একটি সেতু খুবই জরুরি। সাধারণ লোকজন ছাড়াও অনেক শিক্ষার্থীরা এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন। যার ফলে প্রতিদিন সাঁকো পারাপারের ভয়ে বিশেষ করে ছাত্রীরা স্কুলে আসতে পারেনা।
স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য বিমল দাস বলেন, একটি সেতু নির্মাণের জন্য এলাকার লোকজনকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। কিন্তু আজও সেতু পাইনি। জয়চন্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কমর উদ্দিন আহমদ কমরু জানান, ‘গোগালিছড়া নদীতে একটি পাঁকা সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে একাধিকবার জানিয়েছি। কিন্তু কোনো আশ্বাস পাচ্ছিনা। কুলাউড়া উপজেলা এলজিডি কর্মকর্তা খোয়াজুর রহমান বলেন, আমি কুলাউড়ায় নতুন যোগদান করেছি। সরেজমিন পরিদর্শন করে পাঁকা সেতুর বিষয়ে শীঘ্রই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।