পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা বাতিল
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হচ্ছে না। একই সঙ্গে বাতিল করা হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এই দুই পরীক্ষা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত সপ্তাহে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের উপস্থিতিতে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে উভয় মন্ত্রণালয়ে পৃথক দুটি সারসংক্ষেপ তৈরি হচ্ছে। আগামী রোববারের মধ্যে এটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হতে পারে। দুই মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, সমাপনী পরীক্ষা না হলেও এই দুই স্তরের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হবে। এই ফলের ওপর ভিত্তি করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে মেধাবৃত্তি দেয়ার চিন্তা আছে। শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘ না করে বছরের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিভিত্তিক লেখাপড়া শেষ করার চিন্তাভাবনা চলছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া সম্ভব হলে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হবে।
আর ডিসেম্বরের মধ্যে তা সম্ভব না হলে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে ‘অটো-পাস’ দিয়ে তুলে দেয়া হবে। এই উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্যবই বা সিলেবাসের যে অংশটুকু পড়ানো সম্ভব হবে না তার অত্যাবশ্যকীয় পাঠ পরের শ্রেণিতে দেয়া হবে। এজন্য জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ‘কারিকুলাম ম্যাপিং’ করে দেবে। এ লক্ষ্যেই কাল বুধবার এনসিটিবিতে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বৈঠক শুরু হচ্ছে। এছাড়া কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে ময়মনসিংহে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিতে (নেপ) বিশেষজ্ঞদের বৈঠক চলছে।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের আমরা ন্যূনতম ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাই না। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে তখনই তারা স্কুলে যাবে। যেহেতু কবে প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে তা আমরা জানি না। তাই একাধিক বিকল্প হাতে রেখে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, করোনায় শিক্ষায় ক্ষতি পূরণে বিশেষ করে সামনে কোন মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে সে সংক্রান্ত একটা খসড়া প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। মতামতকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এ নিয়ে এনসিটিবি কাজ করবে।
প্রাথমিক স্তর : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে শ্রেণি কার্যক্রম সমাপ্তির লক্ষ্য ধরে কারিকুলাম ও সিলেবাস মূল্যায়নের কাজ করছে নেপ। এ লক্ষ্যে তাদের দুটি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছে।
একটিতে ১ সেপ্টেম্বর ক্লাস কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্য ধরা হবে। আরেকটিতে ১ অক্টোবর থেকে কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৮৮টি কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। ১৬ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মাত্র ৪১ দিন কর্মদিবস পেয়েছিল। কিন্তু তেমন একটা লেখাপড়া হয়নি। উল্লিখিত পরিকল্পনা-১ অনুযায়ী ১ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা মাত্র ৬৬ দিন পাচ্ছে। আর ১ অক্টোবর থেকে স্বাভাবিকভাবে ৫২ দিন কর্মদিবস থাকে। তবে পরিকল্পনা দুটি বাস্তবায়নে শীতকালীন ১০ দিনের ছুটি বাতিল বা কমনোর সুপারিশও আছে।
সূত্র জানিয়েছে, নেপ ইতোমধ্যে পরিকল্পনা-১ বা সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরুর কৌশলের খসড়া তৈরি করেছে। আগামী সপ্তাহে এটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর লক্ষ্যে বর্তমানে ঘষামাজা চলছে। সে অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস কার্যক্রম চলবে। বার্ষিক পরীক্ষা হবে ডিসেম্বরে। আর পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলবে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হবে পিইসি পরীক্ষা। আর পরিকল্পনা-২ তৈরির কাজ চলছে। এটি অনুযায়ী, ১ অক্টোবর থেকে ক্লাস শুরু করা গেলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হবে। সে ক্ষেত্রে বার্ষিক এবং পিইসি পরীক্ষা কবে কোনটি নেয়া হবে সেটা নির্ধারণ করবে মন্ত্রণালয়। এবার পিইসিতে প্রায় ৩২ লাখ শিক্ষার্থী।
নাম প্রকাশ না করে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, উভয় প্লানের ক্ষেত্রেই তারা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সিলেবাস কমানোর চিন্তা করেছেন। আর পঞ্চম শ্রেণির সিলেবাস শেষ করে দেয়া হবে, যেহেতু এসব শিক্ষার্থী আরেক স্তরে চলে যাচ্ছে। আরেকজন বিশেষজ্ঞ জানান, প্রাথমিকের সিলেবাস দক্ষতা অর্জনকেন্দ্রিক। লার্নিং আউটকাম বা শিখনফল অর্জনের সঙ্গে এটা জড়িত। এ কারণে পরের শ্রেণির পাঠের জন্য সিলেবাসের যে অংশ পড়ানো জরুরি সেটা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে রাখা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নেপ মহাপরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর দুই মাসে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা সামনে রেখে কাজ চলছে। বয়স অনুযায়ী শিশুদের শিখনফল সামনে রেখে তৈরি করা এই পরিকল্পনায় অবশ্যই সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ‘কোর সিলেবাস’ বা পরের স্তরের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ থাকবে আর কম গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বাদ যাবে।
মাধ্যমিক স্তর : শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ডিসেম্বরে শেষ করার চিন্তা আছে এই স্তরের লেখাপড়াও। এ কারণে পৃথক তিনটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর একটি সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয়টি অক্টোবর এবং তৃতীয়টি নভেম্বরে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা গেলে কীভাবে পাঠ পরিচালিত হবে সেই পরিকল্পনা আছে। আর করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে নভেম্বরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা ছাড়াই বা অটোপাস দিয়ে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের। এমন ক্ষেত্রে পরের শ্রেণির পাঠের সঙ্গে আগের শ্রেণির সিলেবাসের যেসব অংশ জরুরি তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
জানা গেছে, এ নিয়ে পরিকল্পনা ও ৪১ পৃষ্ঠার সুপারিশ তৈরি করেছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু)। সংস্থার প্রধান ও পরীক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে যে যেই শ্রেণিতে আছে তাদের চলতি শিক্ষাবর্ষের লেখাপড়া ডিসম্বরে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যেও যদি ক্লাস কার্যক্রম শুরু করা যায় তাহলে ডিসেম্বরে জেএসসিসহ বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কী করণীয় সেই পরামর্শ আমরা দিয়েছি।
তিনি বলেন, পাঠদানে শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণিভিত্তিক শিখনফল নির্ধারিত আছে কারিকুলামে। তাই আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী এখন কারিকুলামের আলোকে সিলেবাস নতুন করে সাজানোর প্রয়োজন হবে। যেমন অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজি গ্রামারের ‘ন্যারেশন’ পড়ানো হয়। এর জন্য সপ্তম শ্রেণিতে ‘টাইপস অব সেনটেন্স’ পড়তে হয়। যদি সময়ের অভাবে পড়ানো না যায় এবার তাহলে অষ্টমে আগামী বছর এটা আগে পড়িয়ে নিতে হবে। এজন্য তাহলে এখন ‘লার্নিং গ্যাপ’ (শেখার দুর্বলতা) চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ‘কারিকুলাম ম্যাপিং’ দরকার।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বেডুর জমা দেয়া প্রতিবেদনে বিস্তারিত পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে- এক. আগামী সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠান খুলে যদি নভেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালু রাখাও যায় তবু নির্ধারিত সিলেবাস শেষ করা সম্ভব নয়। এজন্য সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব।
দুই. নভেম্বরে স্কুল খুললে যতটুকু লেখাপড়া করানো যাবে, সেটার আলোকে প্রতি বিষয়ে এক ঘণ্টার এমসিকিউ পদ্ধতিতে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। তিন. এমন পরিস্থিতিতে জেএসসি পরীক্ষার মোট বিষয়ের সংখ্যা কমানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেবল বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা হতে পারে।
চার. নভেম্বর মাসে যদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে সংক্ষিপ্ত কারিকুলাম ও সিলেবাসের আলোকে নিজ নিজ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে শুধু অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষার ফল শিক্ষা বোর্ডগুলোতে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বরধারী ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে।
পাঁচ. ডিসেম্বরেও স্কুল খোলা না হলে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে চলে যাবেন শিক্ষার্থীরা। তবে আগের বছরের মৌলিক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হবে পরের বছর।
সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু : জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী কারিকুলাম নতুন করে সাজাতে বা ‘কারিকুলাম ম্যাপিংয়ের’ জন্য এনসিটিবিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে আগামীকাল বুধবার এ নিয়ে একটি বৈঠকও ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে কারিকুলাম ও সিলেবাস এবং পরীক্ষা বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, ডিসেম্বরে বর্তমান শিক্ষাবর্ষ শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা তৈরির জন্য ক্লাস রুম শিক্ষক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আমরা বসতে যাচ্ছি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরের কোনো মাসে খুলতে পারলে সিলেবাসের কতটুকু পড়াতে হবে, কিভাবে পড়াতে হবে, পরীক্ষা কী করে নেয়া হবে- এসবই নির্ধারণ করা হবে। সিলেবাস সংক্ষেপের কারণে আগামী বছরের জন্য নতুন পাঠ পরিকল্পনা করা হবে। -যুগান্তর