ভারত থেকে আকবরকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশের ১০ লাখ রুপির রফাদফা!
বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় অনেক নাটকীয়তার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর। কিন্তু এরই মধ্যে আকবরের আটক, বাংলাদেশে ফেরা এবং পুলিশের হেফাজতে আসার ঘটনা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল। সিলেট জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ১০ লাখ রুপির বিনিময়ে আকবরকে দেশে ফেরত এনেছেন তারা। তাকে বিক্রি করেছে গোপাল নামে এক ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা চোরাচালানি রহিম উদ্দিন বলছেন, তিনিই খবর পেয়ে পুলিশকে জানিয়েছেন আকবরের সন্ধান।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ১৪ অক্টোবর ভোরে কোম্পানীগঞ্জের উৎমা-বড়পুঞ্জি সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশের পর মণিপুরী যুবক নরেশ সিংহের কাছে আশ্রয় নেন এসআই আকবর। নরেশ সিংহ গাড়ি চালনার পাশাপাশি চুনাপাথরের ব্যবসাও করতেন। প্রথমে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের পাদদেশে মাজাই গ্রামে নরেশের বাসায় আশ্রয় নেন আকবর। ৪-৫দিন সেখানেই থাকেন তিনি। ততদিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নরেশের মূল বাড়ি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও গ্রামে পৌছে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে মাজাই থেকে আকবরকে সরিয়ে শিলং শহরের আলুগুদাম নামক স্থানে রাখেন নরেশ। পরে ২৬/২৭ অক্টোবর সেখান থেকে আসামের শিলচর শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে চাঁচাড় জেলার কালাইন তহশিলের গুমরাহ থানার অন্তর্গত কৈপত্রপাড়া গ্রামে গোপালের বাড়িতে আকবরকে রেখে আসেন নরেশ।
নরেশের আত্মীয় গোপালও আকবরকে পরম আতিথেয়তায় নিজের বাড়িতে রাখেন। এরই মধ্যে নরেশ সীমান্ত এলাকায় এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথা বলে এবং জানায় তার কাছে নেই আকবর। এরপর থেকেই লাপাত্তা নরেশ।
পুলিশ জানতে পারে, আসামের গুমরাহ এলাকায় নরেশের আত্মীয় গোপালের আশ্রয়েই আছেন আকবর। জকিগঞ্জের ফল ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করেন জকিগঞ্জের ওসি মীর মোহাম্মদ আব্দুন নাসের। ফল ব্যবসায়ীরা আসামের এক বিধায়কের ভাগ্নিজামাই আকরামের মাধ্যমে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে জকিগঞ্জের ওসিকে জানান।
গোপাল নিজেই আকবর তার বাড়িতে আছে বলে আকরামকে জানান। এমনকি ছবি পর্যন্ত সিলেটের পুলিশের কাছে পাঠায়। আকরামের মাধ্যমেই গোপালকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চলে। আকবরকে ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন আশ্রয়দাতা গোপাল। দেন দরবার শেষে গত শুক্রবার ১০ লাখ ভারতীয় রুপিতে আকবরকে হস্তান্তর করতে রাজি হয় গোপাল। তবে তাকে রুপিতেই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তার শর্ত অনুযায়ী গোয়াইনঘাটের জাফলং সীমান্তে ১২ লাখ টাকাকে রুপিতে বদল করা হয়। টাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গুমরাহ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে করিমগঞ্জ সীমান্তে আকবরকে ফেরত দেবে বলে জানায় গোপাল।
কিন্তু মাঝখানে নদী এবং দু দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাধার কারণে করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ রুটে ফেরত আনার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে আকবরকে ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন গোপাল। কারণ ওই পথেই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন আকবর। পথঘাট তার চেনা হয়ে গেছে। এছাড়া গুমরাহ থেকে কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের পথও অনেক লম্বা। পথ খুঁজতে থাকে পুলিশ। পরে সিদ্ধান্ত হয় কানাইঘাটের দনা সীমান্ত দিয়েই আকবরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে গোপাল।
এদিকে আকবর ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি যে গোপাল তাকে ১০ লাখ রুপিতে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। গোপাল আকবরকে জানায়, তার বাড়ি নিরাপদ নয়। গৌহাটিতে যেতে হবে। আকবরও তার আশ্রয়দাতার কথায় বিশ্বাস করেন। রোববার অভিজিৎ নামে এক চালকের প্রাইভেটকারে মেঘালয়ের দিকে রওয়ানা হন গোপাল ও আকবর। গোপালের ফন্দি বুঝতে পেরে তার কাছে ১ লাখ রুপি দাবি করেন গাড়িচালক অভিজিৎ।
অন্যদিকে, কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জেমস লিও ফার্গুসন নানকা’র সাহায্য নেয় সিলেটের পুলিশ। রোববার বিকেলে আকবরকে আনতে নানকার নির্দেশেই তার পরিচিত চার খাসিয়া যান কুলিয়াং নামক খাসিয়া পানপুঞ্জিতে। কিন্তু সেখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে পাঠানো খাসিয়া দলটি আকবরের দেখা পায়নি।
কানাইঘাটের ওসির অনুরোধে ওইরাতে কুলিয়াং বস্তির উয়েস নামের এক খাসিয়া যুবকের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন কানাইঘাটের সালেহ আহমদ ও শাহাব উদ্দিন। সে দায়িত্ব নেয় আকবরকে নিজ হেফাজতে রাখবে। এদিকে বাংলাদেশে রহিম ও তার সহযোগীদের ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে রাজি করানো হয় আকবরকে ফেরত আনার জন্য। রোববার গভীর রাতে মেঘালয়ের উখিয়াং থানাধীন সেনা রোডের একটি পেট্রোল পাম্পে আকবরদের গাড়ি থামে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো উয়েস ও তার সহযোগিরা। তারা গোপালের কাছ থেকে বুঝে নেয় আকবরকে। ওই রাতে কুলিয়াং পানপুঞ্জির হেডম্যানের হেফাজতে ছিলেন আকবর। সোমবার ভোরে পুলিশের গাড়িতেই সীমান্তে পৌছান রহিম ও তার সহযোগীরা। ৭টার আগেই তারা সীমান্ত পেরিয়ে কুলিয়াং বস্তিতে পৌছে যায়।
৯টার দিকে তিজাঙ্ঘা নামক স্থানে আকবরকে তাদের হাতে তুলে দেন কুলিয়াং পানপুঞ্জির ওই হেডম্যান এবং খাসিয়া যুবক উয়েস। সেখানে থেকে নাইলনের রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে আকবরকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হয় সীমান্ত পর্যন্ত। এরই মধ্যে এপার থেকে খবর যায় কানাইঘাটে মারামারি চলছে। খবর পেয়ে দনাবস্তি এলকায় পথচলা থেমে যায় রহিম-আকবরদের। ওই সময়ের মধ্যে ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয় আকবরের।
এরপর ১২টার দিকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া মাত্র আকবরকে নিয়ে ১৩৩৫ নম্বর পিলার পেরিয়ে বাংলাদেশের ডোনা সীমান্তে প্রবেশ করেন রহিম ও তার সঙ্গীরা। ১৪ অক্টোবর ভোরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়পুঞ্জি সীমান্তের ১২৫৫ নম্বর পিলার পেরিয়ে ভারতে পালানোর ২৬ দিন পর সোমবার সকালে কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্তের ১৩৩৫ নম্বর পিলার দিয়ে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে ফেরত আনা হয় বাংলাদেশে। রহিম উদ্দিন আকবরকে তুলে দেন পুলিশের হাতে।